
শক্তিশালী ভূমিকম্পে ২১ নভেম্বর সকালে কেঁপে ওঠে দেশ। উৎপত্তিস্থল রাজধানীর খুব কাছে হওয়ায় মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। পরদিনও কয়েক দফায় ভূকম্পন হলে গত সোমবার ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে ওই সেমিনারে রাজউক চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম জানান, ভূমিকম্পের পর রাজধানীতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, ভূমিকম্প হয়েছে শুক্রবার। সরকারি সব অফিস ছিল বন্ধ। রাজউকের সেমিনার হয়েছে সোমবার। মাঝে অফিশিয়াল দিন ছিল কেবল রোববার। একদিনে কিংবা শনিবারও যদি ধরা হয়, মাত্র দুইদিনে ৩০০ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব।
ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিতের ক্ষেত্রে ভবনের কলাম থেকে স্যাম্পল কেটে ল্যাবে নিয়ে টেস্ট করার পরই কেবল বলা যায় সেটির অবস্থা। এছাড়া বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় খালি চোখে দেখেও ভবনের শক্তি কত তা বলতে পারেন। কিন্তু এ বলাটা কখনই প্রমাণযোগ্য হিসেবে ধরা হয় না। রাজউক কোন প্রক্রিয়ায় দুইদিনে ৩০০ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, বিষয়টি পরিষ্কার করেনি।
কোনো ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে অন্তত সাতদিন সময় লাগে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) বর্তমান সভাপতি স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ। রাজউকের ওই সেমিনারে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। আইএবি সভাপতি বলেন, ‘রাষ্ট্রের কাজ গুজবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংস্থা যদি উন্মুক্ত সেমিনারে বিশেষজ্ঞদের সামনে অসত্য তথ্য দেয় সেটা দুঃখজনক। একটি ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অন্তত সাতদিন সময় লাগে। এখানে অনেক টেস্ট করতে হয়। ভবনটা কেন ঝুঁকিপূর্ণ, কোথায় ঝুঁকিপূর্ণ তা ল্যাবে পরীক্ষার আগে বলার কোনো সুযোগ নেই। খালি চোখেও তা বোঝার উপায় থাকে না। ল্যাবে পরীক্ষা ছাড়া কোনো বক্তব্য তো আসলে গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে রাজউক কীভাবে এক-দুইদিনের মাথায় বলে দিল ৩০০ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ তা আমাদের বুঝে আসেনি।’
খোঁজ নিয়ে অবশ্য জানা গেছে, ভূমিকম্পের পর রাজউক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। তবে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছিলেন কেবল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমি ঢাকার বাইরে আছি। রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) মো. মনিরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
পরে রাজউক চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে মো. মনিরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘৩০০ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়ে সোমবার দেয়া রাজউক চেয়ারম্যানের ঘোষণাটি ছিল অনুমাননির্ভর। সংখ্যাটি সঠিক নয়। তবে আমাদের জোনাল অফিসগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা নিয়ে কাজ করছে। রোববারের মধ্যে আমরা সঠিক সংখ্যা জানাতে পারব।’
রাজউকের একটি সূত্র জানিয়েছে, উন্মুক্ত সেমিনারে রাজউক চেয়ারম্যানের ৩০০ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণার পর মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। সংবাদকর্মীরা ভবনের তালিকা চাইলে রাজউক তা সরবরাহ করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে সংস্থাটি এক ধরেনর চাপে পড়ে। তাই তড়িঘড়ি করে একটি তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করছে রাজউক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খানও রাজউকের সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠান যখন কোনো তথ্য দেয় তা অবশ্যই সঠিকভাবে সমীক্ষা করেই দেয়, এটাই আমরা ধরে নিই। কিন্তু তড়িঘড়ি করে কোনো ভুল তথ্য দেয়া সমীচীন নয়। তথ্য না থাকলে সেটা রাজউক স্বীকার করে নেবে, কিন্তু ভুল তথ্য দিলে তো উল্টো বিভ্রান্তি বাড়বে।’
মন্তব্য করুন