দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশে চার বছর ধরে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সংস্থাটির অনুমিত হিসাব, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার হতে পারে ২১ শতাংশের কিছু বেশি। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখে।

দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশে চার বছর ধরে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সংস্থাটির অনুমিত হিসাব, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার হতে পারে ২১ শতাংশের কিছু বেশি। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখে।
দেশে দারিদ্র্যের হার হিসাব করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির খানা আয়ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে আসে।
জিনিসপত্রের দাম জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমাগত। গত দেড় বছরে অর্থনীতিতে একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া কোনো সুখবর নেই। হাজার হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন বিনিয়োগ নেই। বেকারত্ব বাড়ছে প্রতিদিন।
সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চলছে। রাজস্ব আয়ে দুর্বলতা এবং উচ্চাকাক্সক্ষী উন্নয়ন ব্যয়ের কারণে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ ২১ ট্রিলিয়ন টাকা বা ২১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত অর্থ বিভাগের ঋণ বুলেটিনে বলা হয়েছে, জুনের শেষে এই পরিমাণ ২১ দশমিক ৪৪ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছায়, যা এক বছর আগের ১৮ দশমিক ৮৯ ট্রিলিয়ন টাকার চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৯ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন টাকা, যা মোট ঋণের ৪৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। পাঁচ বছর ধরে বৈদেশিক ঋণ ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ২০ ট্রিলিয়ন টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণও বেড়েছে, যা গত অর্থবছরের ১০ দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন টাকা থেকে প্রায় ১১ শতাংশ বেড়ে ১১ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ২২ ট্রিলিয়ন টাকা। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে বেসরকারি ব্যবসা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে ব্যাংকগুলো।
নানামুখী চাপে, চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক ভালো উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীও ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন। অর্থনৈতিক সংকট ও বেসরকারি খাতের এ করুণ দশার প্রভাব ফেলেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। মানুষের আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে। প্রতিদিনের জীবন নির্বাহ করতে এখন মানুষ হাঁসফাঁস করছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক দৈন্যের শেষ নেই। বেসামাল বাজার পরিস্থিতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ফেলে দিয়েছে চরম সংকটে। আয় বাড়েনি, বেড়েছে ব্যয়। ফলে সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। অনেকে আবার করছেন ধারদেনা। শুধু নিত্যপণ্যের দাম নয়, বেড়েছে পরিবহন খরচ, চিকিৎসা ব্যয়, এমনকি শিশুর শিক্ষা। সবখানেই খরচ বাড়ছে হুহু করে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) গবেষণায় উঠে এসেছে, তিন বছরের ব্যবধানে শহরের পরিবারের মাসিক আয় কমলেও বেড়েছে খরচ। শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে এ আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ২০৫ টাকা। তাদের মাসিক খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে গ্রামের মানুষের বেড়েছে ৩ হাজার ৪২ টাকা। তবে সার্বিক ও জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। সঞ্চয় নেই বললেই চলে।
পিপিআরসির জরিপে আরও দেখা যায়, একটি পরিবারের মাসিক মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কেনায়। সে ক্ষেত্রে পরিবার খাবার কিনতে মাসে গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা খরচ করে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপের তথ্যানুযায়ী, একটি পরিবারকে শুধু খাবারের পেছনে মাসে ব্যয় করতে হচ্ছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ২০১০ সালে ১১ হাজার ২০০ টাকা।
অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। সারা দেশে খুন, জখম ও রাহাজানি বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ আজ জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। নদীতে ফেলে দেওয়া লাশের পাশাপাশি জাতীয় ঈদগাহের পাশে ২৬ টুকরো লাশের সন্ধান মিলছে। রাজশাহীতে দায়রা জজ আদালতের বিচারকের বাসায় ঢুকে তাঁর ছেলেকে হত্যা এবং স্ত্রীকে জখম করা হয়েছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে এ রকম হত্যাকাণ্ডের খবর আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
চাঁদাবাজি আর মবসন্ত্রাসে জিম্মি গোটা দেশ। হত্যা মামলার আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ত্রাসীরা টেলিফোনে হুমকি দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা। ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুনের ঘটনা ঘটছে নতুন করে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। পুলিশের পোশাক পাল্টানো হলেও তাদের মনোবল বাড়ানোর দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই। শোচনীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির চেয়ে সরকারের মনোযোগ নানান সংস্কারে। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে এসব সংস্কার কোনো কাজে আসবে না। মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার নিয়ে জনগণ এখন রীতিমতো বিরক্ত।
শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নয় দিনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে নামবে। এর মধ্যে নির্বাচনের আগে পাঁচ দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরে তিন দিন কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। তবে দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী এ সময়সীমা সমন্বয় করা হবে। শনিবার দুপুরে পটুয়াখালী সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি এসব কথা বলেন। কিন্তু এখন যদি সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাবে কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছেই। এ নিয়ে সরকারের উদ্বেগও লক্ষ করা যায় না।
এ দেশের মানুষের চাহিদা খুবই সামান্য। সাধারণ মানুষ তিন বেলা পেট ভরে খেতে চায়। কাজ শেষে নিরাপদে ঘরে ফিরতে চায়। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে চায়। মানুষ চায় তাদের সন্তানদের শিক্ষা, অসুস্থ হলে সঠিক চিকিৎসা। একটু সঞ্চয়, হয়রানি ছাড়া নাগরিক অধিকার লাভ। কিন্তু এ দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, এই সামান্য চাওয়াগুলো কোনো সরকার আন্তরিকভাবে পূরণের চেষ্টা করে না। একটু নিরাপদ জীবনের জন্য, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এ দেশের মানুষ বারবার আশায় বুক বাঁধে। এতটুকু শান্তির জন্য রাজপথে নামে, রক্ত দিয়ে অধিকার আদায় করতে চায়। কিন্তু প্রতিবার এ দেশের মানুষ হয় প্রতারিত। আশাভঙ্গের বেদনায় নীরবে কাঁদে। আমরা কি সেই কান্না শুনতে পাই?
মন্তব্য করুন