
ঘুম থেকে উঠে দেখি মুম্বাই প্রবাসী এক বাল্যবন্ধু ডাক্তারের চার-চারটে মিসড কল। অজানা আশঙ্কায় দুরুদুরু বুকে সাথেসাথেই ফোন করলাম।
ফোনের ওপারে বন্ধুর পরিচিত দৃপ্ত কণ্ঠ শুনে নিশ্চিন্ত হওয়ার আগেই ভেসে এল এক রাশ প্রশ্ন।
“বাংলাদেশের অবস্থা কেমন এখন?” “বাংলাদেশে যাওয়া কি নিরাপদ?” “আমাকে অফিস থেকে যেতে বলছে… কী করি বলো তো?” “গেলে বেঁচে ফিরতে পারব তো?”
এক নিশ্বাসে প্রশ্নগুলো ভাসিয়ে দিল আমার ডাক্তার বন্ধু। গত কয়েক বছরে অন্তত ১৫-১৬ বার কাজের সূত্রে ভ্রমণের সুবাদে বাংলাদেশে একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে আমার বন্ধুর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের অনেক প্রভাবশালী মানুষকে চিনে ফেলেছে অল্প সময়ে। “বাংলাদেশে কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। তুমি সাংবাদিক হতে পারো, কিন্তু আমার অনেক পেশেন্ট আছে বাংলাদেশে,” এই কথা আমাকে বারবার শুনতে হয়েছে।
কোথায় গেল সেই আত্মবিশ্বাস! রসিকতার সুরে জানতে চাইলাম ফোনালাপের সময়।
“না বস, সব বদলে গেছে… ২০২৪-এর আগস্টের পর থেকে যা শুনছি, আমি সত্যি দেশটা চিনি না,” আক্ষেপের সুরে ডাক্তারের স্বীকারোক্তি।
“এক বছরের বিজনেস ভিসা পেয়েছি কাল। কিন্তু খুব টেনশন হচ্ছে। বাংলাদেশ যাওয়া কি ঠিক সিদ্ধান্ত হবে এই সময়?” ডাক্তারের পরবর্তী প্রশ্ন।
এই উদ্বেগের কারণ, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মব কালচারের আস্ফালন, নারীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বৃদ্ধি নিয়ে এরপর কিছুক্ষণ আলাপ চললো।
দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি এবং এই উপমহাদেশের অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব কেমন হতে পারে, তা নিয়েও মত বিনিময় করলাম আমরা। দুজনেই মেনে নিলাম, এই টানাপোড়েনে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষে-মানুষে যোগাযোগ।
শেখ হাসিনার শাসনকালে যেখানে ভারত প্রতিদিন প্রায় ৫,০০০ - ৬,০০০ ভিসা দিত, সেই সংখ্যা এখন ১,০০০ - ১,৫০০।
তেমনি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সর্ববৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ভ্রমণ বা ব্যবসার কাজে ২০২৩ সালে যত মানুষ পাড়ি দিয়েছিলেন, সেই সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতির কারণে দুই দেশই ভিসার ব্যাপারে আগের মতো উদার নেই। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই যাতায়াত কমেছে অনেক।
যদিও বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে ভারতের ভিসার চাহিদা আজও আগের মতই, ভারতীয়দের গল্পটা একটু আলাদা। আমার ডাক্তার বন্ধুর প্রশ্নমালার মধ্যে সুপ্ত ভয় এবং দুশ্চিন্তা প্রমাণ করে বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে একপ্রকার নিরাসক্তি। বাংলাদেশ নিয়ে আবেগী এক বাঙালি ডাক্তারের এই মানসিক অবস্থা মুহম্মদ ইউনূসের শাসনাধীন দেশে কী চলছে, তার একটি সামগ্রিক ধারণার জন্য যথেষ্ট।
ইউনূস সাহেব বলতে পারেন, দেশে সব ঠিক চলছে এবং মানুষ ভালো আছে। বিডা’র কর্তা আশিক চৌধুরী দাবি করতে পারেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে হাসিনার পতনের পর। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বুক উঁচিয়ে বলতে পারেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা জনিত কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু পরিসংখ্যান ঘাঁটলে বোঝা যায়, এসব দাবি ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইউনূস সাহেব দারিদ্র্য নিরসন নিয়ে সারা দুনিয়া ঘুরে বহু বক্তৃতা করেছেন। তাঁর জানা উচিত, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জানিয়েছে দারিদ্র্যের হার ২০২৫ সালে ২১ শতাংশ ছাড়াতে পারে, যা ইদানীংকালে সর্বোচ্চ।
জনাব আশিক চৌধুরী, যিনি দেশের সম্পদ বিদেশীদের কাছে বিক্রির মাধ্যমে অনন্য নজির গড়েছেন। নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ক্রমশ কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে যেখানে আমেরিকার বিনিয়োগ ছিল ২.৮ বিলিয়ন ডলার, তা এই বছরে নেমে এসেছে মাত্র ৫৯.৫৩ মিলিয়ন ডলারে।
কৌতুকশিল্পীর থেকেও বেশি হাস্যরস ঊদ্রেককারি জাহাঙ্গীর সাহেব মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর অক্টোবর মাসের রিপোর্ট নিয়ে অবশ্যই ওয়াকিবহাল। এই রিপোর্টের সারাংশ, হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক সংঘাতে ২৮১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ১৫৩টি পিটিয়ে মারার ঘটনার উল্লেখ রয়েছে অধিকার এর প্রতিবেদনে।
পরিসংখ্যানের গভীরে ডুব দিলে আরও অনেক অস্বস্তিকর তথ্য উঠে আসবে। কিন্তু ইউনূস সরকার নির্বিকার, আর এটাই আজকের দিনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
যারা ক্ষমতায় আছেন তারা মানতে চান না যে, ১৮ কোটি মানুষের এই দেশ সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। সেই কারণেই পশ্চিমের দেশগুলো বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য নানাবিধ নির্দেশিকা ঘোষণা করে চলেছে।
যদিও ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো নির্দেশিকা নেই, কিন্তু আমার ডাক্তার বন্ধুর মনে রয়েছে নানাবিধ উদ্বেগ।
এই উদ্বেগ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এর ফল হতে চলেছে মারাত্মক। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমবে, যার বিরূপ প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে, আর দারিদ্র্যের হার বাড়বে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের যে সমস্ত কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য জলের দরে বাংলাদেশের বন্দর যেসব বিদেশিদের কাছে বিক্রি করছেন, তারা হয়তো বাংলাদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ পর্যটক ও বিনিয়োগকারীরা সরে যাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে। যে দেশের মানুষ আতিথেয়তার জন্য সারা পৃথিবীতে পরিচিত, তাদের কাছে এটি এক দুঃসংবাদ।
এই অশনি সংকেত কী বুঝতে পারছেন, ইউনূস সাহেব? বুঝে কী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন উনি?
আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হয়না, কারণ উনি স্বীকার করেন না, দেশে কোনো সমস্যা আছে।
এই অজ্ঞতায় উনি পরমানন্দে থাকতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের সামনে সমূহ বিপদ।
মন্তব্য করুন