
চাঁদের উৎপত্তি নিয়ে দীর্ঘদিনের আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর সোলার সিস্টেম রিসার্চের গবেষকেরা। তাঁদের প্রস্তাবিত সাম্প্রতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে থেইয়া নামে মঙ্গল-গ্রহ আকৃতির একটি বিশাল গ্রহাণু পৃথিবীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেই সংঘর্ষের ফলেই চাঁদের সৃষ্টি, আর থেইয়া পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে পৃথিবী ও চাঁদের খনিজগঠনেই থেইয়ার অস্তিত্বের ক্ষীণ চিহ্ন পাওয়া যায়।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, পৃথিবী ও চাঁদ থেকে সংগৃহীত খনিজের অনুপাত পর্যালোচনা করে তাঁরা থেইয়ার উৎস সম্পর্কিত বহু জটিল বিষয় উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ বিষয়ে গবেষক টিমো হপ বলেন, গ্রহ গঠনের শুরুতে অসংখ্য গ্রহাণু-ভ্রূণের সংঘর্ষের মধ্যে থেইয়া ছিল অন্যতম। সৌরজগত গঠনের প্রথম ১০ কোটি বছর থেইয়া অভ্যন্তরীণ কক্ষপথে পৃথিবীর অদৃশ্য প্রতিবেশী হিসেবে স্থিতিশীলভাবে ঘুরছিল। পরে সংঘর্ষে থেইয়ার টিকে থাকা অংশ পৃথিবী অথবা চাঁদের ভেতরে শোষিত হয়ে যায়।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, সৌরজগতের জন্মপর্বে বিভিন্ন উপাদানের আইসোটোপ সমানভাবে ছড়ায়নি। সেই সময়ই থেইয়া আদি-পৃথিবীকে আঘাত করে, আর সংঘর্ষে দুটি মহাজাগতিক দেহ একত্রে মিশে গিয়ে পৃথিবী ও চাঁদের বর্তমান রূপ তৈরি হয়। এই অনুসন্ধানের ফল ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
পৃথিবী থেকে পাওয়া শিলা, নাসার অ্যাপোলো মিশনে সংগৃহীত চাঁদের নমুনা এবং বিভিন্ন গ্রহাণু থেকে সংগৃহীত উপাদানের লোহার আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—চাঁদ ও পৃথিবীর আইসোটোপিক অনুপাত প্রায় অভিন্ন। এতে প্রমাণ মেলে, থেইয়া ও আদি-পৃথিবীর উপাদান এতটাই ভালোভাবে মিশে গিয়েছিল যে, তাদের পৃথকভাবে শনাক্ত করা এখন প্রায় অসম্ভব। বিজ্ঞানী হপের ভাষায়, আইসোটোপের এই সাদৃশ্য থেইয়ার প্রাথমিক গঠন সরাসরি বোঝার পথ প্রায় বন্ধ করে দেয়।
গবেষকেরা আরও ব্যাখ্যা করেন, যদি থেইয়া সৌরজগতের দূরবর্তী ঠান্ডা অঞ্চলে গঠিত উল্কাপিণ্ডের মতো হতো, তবে পৃথিবী ও চাঁদের আইসোটোপিক বৈশিষ্ট্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যেত। বরং ধারণা করা হচ্ছে, থেইয়া ও আদি-পৃথিবী দুটিই সৌরজগতের অভ্যন্তরীণ অংশে তৈরি হওয়া শিলাময়, অ-কার্বনেশিয়াস উল্কাপিণ্ড দিয়ে গঠিত ছিল। প্রায় ১০ কোটি বছর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পর বৃহস্পতির মহাকর্ষীয় প্রভাব থেইয়াকে স্থিতিশীল কক্ষপথ থেকে সরিয়ে পৃথিবীর দিকে ঠেলে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত দুই মহাজাগতিক দেহের সংঘর্ষের কারণ হয়।
মন্তব্য করুন